বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন সোনার বাংলার। তিনি তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যে আমৃত্যু সংগ্রামও করেছিলেন। স্বাধীন ভূখন্ডের চেহারা বদলাতেই যেখানে হিমশিম খেতে হয় সেখানে পাকিস্তানের মতো প্রবল পরাশক্তির হাত থেকে এই ছোট্ট ভূখন্ডটিক মুক্ত করে একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। তিনি তাই বাঙালির জাতির পিতা। তিনি প্রাতঃস্মরণীয় শেখ সাহেব। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। সারাটা জীবন তার সংগ্রামেই কাটলো। প্রথমে পাকিস্তান আন্দোলন। তারপর সেই পাকিস্তানের কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম। ক্ষমতার মুখ দেখেছিলেন মাত্র দুবার। তাও অত্যন্ত স্বল্প মেয়াদে। সেই ১৯৫৪ সালের যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচনের পর। দ্বিতীয়বার ১৯৫৬ সালে। তা থেকেও সরে দাঁড়ালেন। সরে দাঁড়ালেন বৃহত্তর স্বার্থের লক্ষ্যে। সেই স্বার্থ নিজের নয়। দেশের দশের বাঙালী জাতির। সেই স্বপ্ন স্বাধিকারের। সেই স্বপ্ন স্বাধীনতার। শেখ মুজিবের সব চেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে তিনি বাঙালীর কল্পনার চাইতেও বড় কিছু এনে দিয়েছিলেন। তিনি যে কত বড় একটা জিনিস এনে দিয়েছিলেন তা আজ তিলে তিলে প্রমানিত। তিনি যা এনে দিলেন তার যতœ করার মতো মানুষটুকুও আমরা হতে পারলাম না। সেই মনুষ্যত্বটুকুও অর্জন করতে পারলাম না। ১৯৭৫ সালেই আমরা সেই মহান মানুষটাকে হত্যা করেছিলাম স্বপরিবারে। অনেক মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছিলো তাকে এবং তার পরিবারকে। কিন্তু মৃত্যুর পর কিছুই প্রমাণিত হয়নি। মূলতঃ পুরোটাই ছিলো ধোঁকা। একটা সদ্য স্বাধীন জাতিকে বিভ্রান্ত করার জন্য কতিপয় অতি চালাক, লোভী আর জঘন্য মানুষের নোংরা ষড়যন্ত্রের কাছে সেদিন জাতির বিবেক পরাস্ত হয়েছিলো। অথচ বাঙালীর তো তার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকার কথা ছিলো।
অনেক কথা বলতে শোনা যায়। তিনি বাকশাল কায়েম করেছিলেন। আজ দেশের যে অবস্থা তাতে যদি কারো সামান্য বিবেক বুদ্ধি থাকে তাহলে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে শুধুমাত্র তাদের উদ্দেশ্যেই বলতে চাই এই ২০১৯ এ এসে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৫ সালের বাকশালের আজ বড় প্রয়োজন। জাতির আজ সেই সন্তানের বড় প্রয়োজন যে জাতির পতাকা খামচে ধরা স্বার্থপর, লোভী, হিং¯্র শকুনদের হাত থেকে এ জাতিকে রক্ষা করতে পারবে।
আমি বুঝি প্রধানমন্ত্রী কতোটা আঘাত পাচ্ছেন প্রতিটি দুঃসংবাদে। তিনি যাবেন কোথায়? কার উপর ভরসা করবেন? যাকেই দায়িত্ব দিচ্ছেন সেই ভুলে যাচ্ছে সেও একদিন মানুষ ছিলো। আমাদের ভেতরের বিকৃতি আমাদের কতোটা দানবে পরিণত করেছে তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে।
আমার যারা অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ তারা সুযোগ পেলেই প্রতিটি ইস্যুকে রাজনৈতিক বানিয়ে ফেলি। আঙ্গুল তুলি দলের দিকে। এতে আমাদের দায় এড়াতে সুবিধে হয়। একবার ভাবিনা এই সামাজিক অবক্ষয় আর মানবিক বিপর্যয়ের দায় শুধু আমাদেরই। যারা আজ এসব করছে তারা আমাদের কারো না কারো ভাই, বন্ধু, আত্মীয়।
আমি জানি এদেশে নেত্রী তথা আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ে বিকৃত আনন্দ লাভের মতো নেমক হারামের কোন অভাব নেই। এ দেশের মাটিতে খেয়ে এ দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রচ্ছাব করে দিতে এদের এতটুকুও আটকায় না। অকৃতজ্ঞতার একটা সীমা-পরিসীমা থাকে। বাঙালী সম্ভবতঃ স্মরণকালের সব সীমারেখা অতিক্রম করেছে। পৃথিবীতে এতোটা অধঃপতিত জাতি এই মুহুর্তে পাওয়া বিরল।
পারমাণবিক বালিশ, রূপার ঢেউটিন, হিরক খচিত পর্দা, যত্রতত্র বাঁশের ব্যবহারের পাশাপাশি সর্বশেষ যখন এই খবর পাই যে ১০ কোটি টাকার সম্পদ পাহারা দিতে ব্যয় ৪৬ কোটি টাকা তখন মাথা ঠিক রাখা কঠিন হয়ে যায়। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে হয় এদের জন্মও কি তবে প্রশ্নবিদ্ধ। হয়তো তাই। কারণ উপর থেকে সবকিছু বোঝা যায় না। নইলে হিং¯্র পশুর পক্ষেও এতো অমানবিক হওয়া কঠিন।
আমরা মূলতঃ দিন দিন কোথায় যাচ্ছি। কি প্রমাণ করছে এই সব বিকৃত মন মানসিকতা। চারিদিকে হত্যা, ধর্ষণ, লুট। যারা জড়িত তারাই সমাজের আদর্শ। আশ্রয় স্থল। শিক্ষক, ইমাম, কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি। সবাই এখন আফ্রিকার মাঠে অবাধে বিচরণকারী হিং¯্র প্রাণীদের হার মানাচ্ছে যেখানে বেঁচে থাকার মূলনীতি হচ্ছে হিং¯্রতা এবং স্বার্থপরতা।
আমাদের পাশের দেশে মহাত্মা গান্ধী জন্মেছিলেন। এদেশে শেখ মুজিবুর রহমান। উভয়েই স্বপ্ন দেখেছিলেন সুন্দর একটা স্বদেশ। ভারতে উগ্রপন্থা আর বাংলাদেশের দুর্নীতি এতাটা তীব্র আকার ধারণ করেছে যে একে মহামারি বললেও কম বলা হবে।
স্বাধীনতার পর স্বপ্ন পূরণের পথেই হাঁটছিলো জাতি। কুচক্রীদের সেটা ভালো লাগল না। তারা চাইল রাজনীতি হবে তাদের হাতের পুতুল। দেশ অন্ধকারের পথে পা বাড়াল। পাকিস্তান তার সামরিক শাসনের কারণে পঙ্গু হয়ে গেলো। আজ সে বিধ্বস্ত অর্থনীতির একটা দেশ। বাংলাদেশের এক টাকা পেতে তাদের দিতে হয় প্রায় ১ টাকা ৬৪ পয়সা। বাংলাদেশও ১৯৭৫ সালর ১৫ই আগষ্টের পর সেই পথে হাঁটতে শুরু করেছিলো। সর্বশেষ যে বাধাটুকু এসেছিলো ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের কাছ থেকে তাও উড়ে গেল কাছের লোকের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। হায়রে স্বদেশ আমার। মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী হয়ে গেলো।
ভাগ্য ভালো বাংলাদেশের। ১৯৯০ সালে এসে পথ খুঁজে পেলো। তবে তা সাময়িক। নির্বাচনে আবারও সেই পাকিস্তান পন্থীরা। তবু তো সামরিক শাসনের অবসান হলো। আমরা আশায় ছিলাম একবার যখন স্বৈরাচার হটেছে একদিন না একদিন আশা পূরণ হবে। স্বাধীনতা পন্থীদের ক্ষমতায় আসতে এতোটা দেরী হচ্ছিল যে পরিস্থিতি দেখে এমনটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তবে কি মুক্তিযোদ্ধারা জীবন দিয়ে এদেশ স্বাধীন করে ভুল করেছিলো। তবে কি শেখ মুজিব মৃত্যুকে মেনে নিয়ে এদেশের স্বাধীনতা চেয়ে ভুল করেছিলেন। হায়রে স্বদেশ আমার। তোমার অসহায় করুণ মুখ বার বার জাতির পিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। জাতির পিতা বেঁচে থাকলে আজ এসব দেখে বড় কষ্ট পেতেন। বুক চাপড়ে হয়তো বলতেন, আমি এই বাংলা চেয়েছিলাম।
দেশ রতœ শেখ হাসিনা আপোষহীন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীক, সৎ আর সাহসী নেত্রী। তার ত্যাগ, তিতিক্ষা আর দূরদর্শিতার কারণে আজ বাংলাদেশ এখানে। তিনি চাইলে কিনা করতে পারতেন। কিন্তু শুধু তিনিই নন আর আপনজনদের বিরুদ্ধেও যেখানে কোন অভিযোগ নেই সেখানে কোন সাহসে আমরা এমন পৈশাচিক খেলায় মেতে উঠি।
আজ সময় এসেছে অপরাধীদের সনাক্ত করে টেনে রাজপথে নামিয়ে নিয়ে আসার। জনগণের সামনে তাদের মুখোশ উম্মোচন করার। জাহাঙ্গীর নগরের ঘটনায় শোভন-রাব্বানীর নামই শুধু নয় অন্য যারা জড়িত তাদেরকেও সনাক্ত করা হোক। এরকম আরও যতো ঘটন-অঘটন-দূর্ঘটন আছে তা চিহ্নিত করা হোক। সবচেয়ে বড় কথা কেউ যেন অপরাধ করে আর পার না পায়। এ দেশ আর এ মাটি কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় যে দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাবে। আর এখনও এমনটা ভেবে ভুলের সাগরে ডুবে আছে তাদের সাবধান হওয়ার এখনি সময়।
আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীর কোন সমালোচনা নয়। বরং আমরা জানিয়ে দিতে চাই তার প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের পূর্ণ সমর্থন আছে। প্রতিটি কঠিন সিদ্ধান্তে তিনি আমাদের পাশে পাবেন। বিগত দিনগুলোতে তার হাতে হাত রেখে আমরা যেভাবে সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছি। যুদ্ধপরাধীদের বিচার করেছি, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করেছি, জেলখানায় জাতীয় চার নেতার হত্যাকান্ডের বিচার করেছি তেমনি এবারও আমরা দুর্নীতিকে রুখবই রুখবো। মনে রাখতে হবে এদেশ আমাদের সবার। এর সুরক্ষা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব।
Leave a Reply