news2bdgazette@gmail.com বৃহঃস্পতিবার, ৯ই মে ২০২৪, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩১

প্রকল্পের ড্রয়িং বোর্ডে থমকে আছে দেশের প্রথম শহীদ মিনার

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত:
২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, ১৫:০৩

ছবি: সংগৃহীত

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, বাংলা ভাষার জন্য তাঁদের প্রাণ উৎসর্গ করেন রফিক, শফিক, বরকত, সালামরা। ইতিহাস সাক্ষী, এই ভাষা শহীদদের স্মরণে রাজশাহীতেই গড়ে উঠে দেশের প্রথম শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। পাকিস্তানি জান্তার চাপকে অগ্রাহ্য করে, রাজশাহী কলেজের মুসলিম হোস্টেলের প্রাঙ্গণে ইট-সুরকি ও কাদা-মাটি দিয়ে রাতের আঁধারে নির্মিত হয় শহীদ মিনারটি। অত্যন্ত দুঃখজনক যে, দেশের প্রথম শহীদ মিনার হওয়া সত্ত্বেও এটি আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি।

ভাষা শহীদদের অমর স্মরণে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারটি নতুন করে নির্মাণের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের অক্টোবরে রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০২০ সালের ৩০ জুনের মধ্যেই রাজশাহী কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাস প্রাঙ্গনে এর পুনঃনির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। তবে, প্রকল্পটি পাইলিং পর্যায়েই আটকে গেছে।

নির্মিতব্য শহীদ মিনারটির নকশা অনুযায়ী, তিনটি পিলারের মধ্যে বড়টির উচ্চতা ৫৫ ফুট হবে এবং এটি সিলভার রংয়ের হবে। মধ্যম ও ছোট পিলারের উচ্চতা যথাক্রমে ৪০ ও ৩০ ফুট হবে, যেগুলি পোড়ামাটির রংয়ে হবে। এছাড়া, শহীদ মিনারের বেদীতে এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য লিপিবদ্ধ থাকার কথা রয়েছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের অধীনে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের ব্যয় ধার্য করা হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। তিন বছর আগে পাইলিংয়ের কাজ শেষ হলেও, প্রকল্পটি আজও আলোর মুখ দেখেনি। অজ্ঞাত কারণে শ্রদ্ধা স্মারক নির্মাণ কার্যক্রম থেমে আছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

৫২’র ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন সাঈদ উদ্দিন আহমদ। ২০১৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে ৮৪ বছর বয়সে মারা যান এই ভাষাসৈনিক। ২০১৫ সালের ১৯ জুলাই ৭৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভাষাসৈনিক আবদুর রাজ্জাক। আরেক ভাষাসৈনিক আবুল হোসেন ৮৭ বছরে বয়সে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ মারা যান। মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী বয়সের ভারে অসুস্থ থাকলেও রাজশাহীতে প্রথম শহীদ মিনারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেখার আশায় বেঁচে আছেন।

ভাষা সৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী বলেন, ঢাকার পরে, বাংলা ভাষার আন্দোলন রাজশাহীতে খুব জোরদার ছিল। ঢাকায় গুলির খবর শুনে, আমরা রাজশাহীর ছাত্র ও মেসের সবাইকে খবর দিয়ে রাজশাহী কলেজে জমায়েত করি।

সেখানে এক সভায় নেতারা বলেন যে, গুলি করা খুবই নৃশংস ও নিন্দনীয় কাজ। তারা ঠিক করেন যে, শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বানাবেন। এর জন্য, গোলাম আরিফ টিপু, এস এম আব্দুল গাফফার, মনতাজ উদ্দিন, অ্যাডভোকেট মহসিন প্রামাণিক, অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক, ইঞ্জিনিয়ার নাজমুল, মহির উদ্দিন এবং অন্যান্যরা ইট ও পাথর জোগাড় করে কাদামাটি দিয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন। স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও এটি না থাকাটা খুবই দু:খজনক।

স্মৃতিস্তম্ভে লেখা ছিল, ‘উদয়ের পথে শোন কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। রাতভর আমরা এটি পাহারা দেই। পরের দিন শুনি, মুসলিম লীগের লোক ও পুলিশ এটি ভেঙে ফেলেছে। এই ঘটনায়, ভাষাসৈনিকরা রাজশাহী কলেজের স্মৃতিস্তম্ভটিকে দেশের প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানান।

মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক ওলিউর রহমান বাবু জানান, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী কলেজের মুসলিম হোস্টেলের পাশে কলেজের ভাষা সৈনিক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে দেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। ঢাকায় এ সময় শহীদ মিনার তৈরির পরিস্থিতি ছিল না, ফলে এটি দেশের প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে গণ্য হয়।

২১ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায়, ঢাকার ঘটনার সংবাদ রাজশাহী পৌঁছানোর পর, তৎকালীন ছাত্রনেতারা হোস্টেলের একটি রুমে মিলিত হয়ে শহীদদের স্মরণে কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সারা রাত ধরে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি করা হয়। আশপাশের মানুষজন এই উদ্যোগে সহযোগিতা করেন। ওলিউর রহমান বাবুর মতে, এই প্রথম শহীদ মিনারের স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল, যা এখনও পায়নি।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, রাজশাহী কলেজের মুসলিম হোস্টেলের পাশে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের কেন্দ্রে একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তৈরির দাবি উঠেছিল। এই দাবিকে ভাষা সৈনিকসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, এবং সাধারণ মানুষ সমর্থন করেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও, অজানা কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে, যা বাবুর জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। একটি নতুন জায়গায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজও সেভাবে এগোচ্ছে না, যা বিভিন্ন প্রশ্ন রেখে যায়।

রাজশাহী কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাস আমরা দেখি সেখানে জাতীয়ভাবে একটি বিষয়কে অনেকটা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলা যায়। সেটি হচ্ছে এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম শহীদ মিনারটি গড়ে উঠেছিল রাজশাহী কলেজ মুসলিম ছাত্রবাস প্রাঙ্গণে।

রাজশাহীতে অবস্থিত দেশের প্রথম শহীদ মিনারের জন্য স্বীকৃতির অভাব একটি বেদনাদায়ক ও উদ্বেগজনক বিষয়। এই শহীদ মিনার আমাদের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ও ত্যাগের প্রতীক। তাই, একে উপযুক্ত স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদান করা না শুধু আমাদের ইতিহাসের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন, বরং সেই শহীদদের প্রতি আমাদের ঋণ শোধের একটি উপায়। এর সঠিক সংরক্ষণ, প্রচার, এবং স্বীকৃতির জন্য জরুরি উদ্যোগ নেওয়া অপরিহার্য। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির গৌরবময় ইতিহাসের কথা জানাতে পারব।

রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল খালেক বলেন, আমরা গর্বিতভাবে বলতে পারি, ভাষা আন্দোলনের যে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল, তা রাজশাহী কলেজে হয়েছিল। রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনের সময় হওয়া মিছিলগুলো সাধারণত রাজশাহী কলেজের ফুলার ভবনের সামনে জড়ো হতো এবং সেখান থেকে শুরু হতো। ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনারটি রাজশাহী কলেজের মুসলিম হোস্টেলের গেটের পাশে নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে সেখানে একটি সাধারণ স্থাপনা রয়েছে। একটি মানসম্মত শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালে একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছিল। পরবর্তীতে, সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা প্রকল্পটির উদ্বোধন করেছিলেন। আমরা সেই শহীদ মিনারের থ্রিডি নকশাও দেখেছি। জায়গা নির্ধারণের পর, সেখানে লে-আউট দেওয়া হয়েছিল। শোনা গিয়েছিল, এর ফান্ডিং সিটি কর্পোরেশন ও সরকারের যৌথ উদ্যোগে হবে, কিন্তু উদ্বোধনের পর প্রকল্পটি আর এগোয়নি।

প্রতি বছর আমরা এর অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজ নেই এবং আশ্বাস পাই যে, শীঘ্রই বরাদ্দ পাওয়া যাবে এবং কাজ শুরু হবে। উদ্বোধন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে, তাই আমরা বিশ্বাস করি এটি অবশ্যই সম্পন্ন হবে। মেয়র ও সংসদ সদস্যের যৌথ উদ্যোগে এই প্রকল্পটি সফল করা সম্ভব, এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর