news2bdgazette@gmail.com সোমবার, ২০শে মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ভুল চিকিৎসায় মায়ের মৃত্যুর অভিযোগ, দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ছেলে

সারাবাংলা ডেস্ক

প্রকাশিত:
৬ মে ২০২৪, ১৪:৫০

সংগৃহিত ছবি

‘আমার আম্মা স্ট্রোক করলে তাকে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করি। ভর্তির ১৩ দিন পর্যন্ত আম্মা সুস্থ ছিলেন; তার চিকিৎসা চলছিল। তখন কেবল তীব্র মাথাব্যথা ছিল তার। এরমধ্যে চিকিৎসকরা তার অপারেশনের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান। গত ২৮ ডিসেম্বর আম্মুকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। ৪ ঘণ্টার অপারেশন শেষে আম্মুকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হলেও তিনি আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেননি। এভাবেই ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় থাকার পর মারা যান। আম্মুর অপারেশন থেকে শুরু করে সামগ্রিক চিকিৎসায় গাফিলতি ছিল চিকিৎসকদের। তাদের বারবার কাকুতি মিনতি করেও আম্মুর সংজ্ঞাহীন হয়ে যাওয়ার কারণ জানতে পারিনি। চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসার কারণেই আম্মু মারা যান’— কান্না জড়িত কণ্ঠে দেশ রূপান্তরকে কথাগুলো বলছিলেন রুহুল আমিন। তিনি রংপুররে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। 

রুহুল আমিনের মা রফিকুন্নাহার ডাকনাম পলি খাতুন (৬০) গত ১৩ই ডিসেম্বর পাবনার ঈশ্বরদীতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে রোগ শনাক্তে বিলম্ব হলে পরদিন স্থানীয় একটা ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকেরা তার মায়ের ব্রেন স্ট্রোক শনাক্ত করে ঢাকায় নিয়ে আসার পরামর্শ দেন। এরপর ১৫ ডিসেম্বর ভোররাতে পলি খাতুনকে আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ডাক্তার রাজিব নারায়ণ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা শুরু হয়। 

রুহুল আমিন অভিযোগ করে বলেন, তার মায়ের মৃত্যু ভুল চিকিৎসায় হয়েছে। অপারেশনের পদ্ধতি এবং খরচ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন চিকিৎসকরা। অস্ত্রোপচারে অবহেলায় তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে এবং এর জন্য সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার সিরাজী শফিকুল ইসলামকে দায়ী করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তিনি। তার অভিযোগের পর হাসপাতাল থেকে ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. কাজী মহিবুর রহমানকে সভাপতি করে একটা তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. কাজী মহিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু এটা সেন্সেটিভ বিষয় তাই আমি কোনো মন্তব্য করতে পারবো না। আমরা তদন্ত রিপোর্ট হাসপাতালের পরিচালক বরাবর জমা দিয়েছি। 

নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে রফিকুন্নাহারের অপারেশন হয় ২৮ ডিসেম্বর। তার পরিবারের দাবি অপারেশন কক্ষে নেওয়া পর্যন্ত রফিকুন্নাহার স্বাভাবিক ছিলেন। এমনকি খাবার গ্রহণ থেকে শুরু করে হাঁটাচলা ও কথাবার্তা স্বাভাবিক ছিল। তিনি তাদের সঙ্গে গল্প করতেন। তবে মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। 

রুহুল আমিন অভিযোগ করে বলেন, চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন আম্মুর যে ধরনের সমস্যা তাতে কয়েলিং এবং ক্লিপিং বা সার্জারি এই দুই ধরনের অপারেশন করা হয়। এরমধ্যে ক্লিপিং করতে ৪০ হাজার টাকার মতো খরচ হয় কিন্তু এই পদ্ধতি বয়স্ক মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে তার কয়েলিং প্রয়োজন হবে এই পদ্ধতিতে অপারেশনে খরচ আসবে ২ লাখ টাকার মতো, আমরা তাতে রাজি হই। ২১ ডিসেম্বর আম্মুর ডিএসএ টেস্ট করেন ডাক্তার সিরাজী শফিকুল ইসলাম। যেখানে রিকমেন্ডেশন আসে তার স্টেন্ট অ্যাসিস্টেড কয়েলিং প্রয়োজন। এরপর থেকে ডাক্তার সিরাজির তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলছিল। 

২৮ ডিসেম্বর অপারেশনের পর ডাক্তার সিরাজি রুহুল আমিনকে ল্যাবের কক্ষে ডেকে নিয়ে যান এবং তার মায়ের স্টেন্ট বসানো হয়নি বলে জানান। স্টেন্ট না বসানোর কারণ জানতে চাইলে তাকে বলেন, ‘রোগীর ১৭ মিলিমিটার স্টেন্ট লাগতো কিন্তু তাদের কাছে ৩৪ মিলিমিটারের স্টেন্ট ছিল তাই পরানো হয়নি। সেদিন বিকেলে রফিকুন্নাহারকে অপারেশন কক্ষ থেকে বের করা হলে তার শরীরে রেসপন্স ছিল না, তিনি কেবল বাম হাত উঁচু করা এবং সামান্য চোখের পাতা খুলতে পারছিলেন বলে অভিযোগ রুহুলের। 

পরদিন ২৯ ডিসেম্বর তার মায়ের সিটি স্ক্যান করা হলেও এ বিষয়ে হাসপাতাল থেকে তাদের কিছু জানানো হয়নি। সিটি স্ক্যানের রিপোর্টে দেখা যায় তার আরেকবার স্ট্রোক হয়েছে এবং ব্রেনের টিস্যু ডেড হয়েছে। ৩ দিনেও মায়ের জ্ঞান না ফেরায় ৩১ ডিসেম্বর ডাক্তার সিরাজীর সঙ্গে দেখা করেন রুহুল। সেদিন তাকে সিরাজী বলেছিলেন জ্ঞান ফিরতে আরেকটু সময় লাগবে। ৪ জানুয়ারি পুনরায় সিরাজীর সঙ্গে দেখা করেন রুহুল। 

সেদিন সিরাজী বলেন, ‘আমি ভাবছিলাম রোগীর অ্যানিউরিজম আর্টারি থেকে অনেক দূরে সেজন্য সেখানে শুধু কয়েলিং করলেই চলবে স্টেন্ট বসানোর প্রয়োজন নাই। রোগীর এখন যে অবস্থা তাতে সেন্স ফেরার সম্ভাবনা খুব কম এবং রিকভারি করার চান্স মাত্র ১০ ভাগ।’

ডাক্তার সিরাজীর এমন কথা শুনে ওইদিনই রুহুল হাসপাতালের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলমের কাছে মৌখিক অভিযোগ জানান। এরপর ৬ জানুয়ারি হাসপাতালের পরিচালক ডা. দ্বীন মোহাম্মদের সঙ্গে দেখা করে রুহুল ডাক্তার সিরাজীর অসংলগ্ন কথাবার্তা ও ভুল চিকিৎসার বিষয়ে অভিযোগ জানান। হাসপাতালের পরিচালকের নির্দেশে একইদিন দুপুর ১২টায় আরেকটা বৈঠক হয় যেখানে উপস্থিত ছিলেন, হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক ও ডাক্তার সিরাজী এবং আরও ৮-৯ জন সিনিয়র চিকিৎসক।

মৃত রফিকুন্নাহারের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, ২৩ ডিসেম্বর ডাক্তার সিরাজী তাদের বলেন রফিকুন্নাহারের অপারেশনের জন্য ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা লাগবে। যদিও একটু পর ডাক্তার সিরাজী বলেন অপারেশনে ৩-৫ লাখ টাকা খরচ হবে। এই টাকা জমা দিলে পরদিন তার অপারেশন করা হবে। এ সময় তারা প্রশ্ন করেন, আগে হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছিল এই অপারেশনে খরচ হবে ২ লাখ টাকা এবং সেই টাকাই তারা সংগ্রহ করেছেন। এখন হঠাৎ করে কেনো টাকা বেশি লাগছে। এই প্রশ্ন শুনে ডাক্তার সিরাজী তাদের বলেন, এই টাকা ছাড়া অপারেশন হবে না এবং তার এক সহকর্মীকে রোগীকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দিতে বলেন। ফলে তারা বাধ্য হয়ে ২৪ ডিসেম্বর ৩ লাখ টাকা জমা দেন। এই টাকার বিনিময়ে তাদের একটা সাদা কাগজে মানি রিসিট দেওয়া হয় এবং জানানো হয় অপারেশনের পর পূর্ণাঙ্গ খরচ হিসেব করে সরকারি রিসিট দেওয়া হবে। 

টাকা জমা দেওয়া হলেও ২৪ তারিখ রফিকুন্নাহারের অপারেশন করা হয়নি এবং নতুন তারিখ দেওয়া হয় ২৭ ডিসেম্বর। যদিও সেদিন অপারেশন না করে ২৮ ডিসেম্বর তার অপারেশন শুরু হয়।

হাসপাতালের মিডিয়া বিভাগের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ডা. জহিরুল হক চৌধুরী বলেন, চিকিৎসকরা সবসময় চেষ্টা করেন রোগীকে সুস্থ করার। হাসপাতালের চিকিৎসকদের নিবেদন নিয়ে কখনো প্রশ্ন উঠেনি। তাদের অভিযোগের বিপরীতে যে কমিটি গঠন হয়েছিল তারা তাদের কাজ করেছেন। এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর