news2bdgazette@gmail.com বৃহঃস্পতিবার, ৯ই মে ২০২৪, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩১

আমের শহরে মুকুল কম, চাষিদের দুশ্চিন্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত:
২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, ১৮:৩৩

ছবি: সংগৃহীত

তাপমাত্রার ধীরগতির বৃদ্ধি প্রকৃতিতে নানা পরিবর্তন আনছে। দিনে গরমের প্রকোপ থাকলেও রাতে তা কমে আসছে। বসন্তের ১৩ দিন অতিক্রান্ত হলেও, ফাগুনের প্রত্যাশিত উত্তাপ এখনও প্রকৃতিতে পূর্ণরূপে অনুভূত হচ্ছে না। তবে, ফাগুনের আগমনে শিমুল ও পলাশ ফুটেছে, যদিও আমের মুকুলের ঝিলিক এখনও মিলছে না। এ সময়ে আমের গাছে মুকুলের প্রাচুর্য দেখা যাওয়ার কথা থাকলেও, অধিকাংশ গাছে মুকুলের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। কৃষিবিদরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও তীব্র শীত এর অন্যতম কারণ হতে পারে।

প্রকৃতির এই পালাবদলে মানুষের মন আন্দোলিত হচ্ছে। ঋতু বৈচিত্র্যে ভরা আমের শহর রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের সবুজ প্রকৃতি এখন এক আবেগময় আমেজে ডুব দিয়েছে। বসন্তের ফাগুন এবং আমের মুকুল যেন একই সুতোয় বাঁধা। এই সময়ে, রাজশাহীর আম চাষি ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের চোখ আম বাগানের দিকে। আমের সবুজ পাতা ও মুকুল চাষিদের রঙিন স্বপ্নকে দোলা দিচ্ছে। এই দৃশ্য শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত।

রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলার প্রায় সব এলাকায় এখন প্রচুর আম বাগান রয়েছে। নতুন নতুন জাতের আমের উদ্ভাবন ও বাগান তৈরি হচ্ছে, যা অল্প সময়ে ফলন দিচ্ছে। তবে, অধিকাংশ গাছে মুকুল না আসায় চাষিরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।

বাংলাদেশে আম অর্থনীতিতে একটি লাভজনক মৌসুমী ফলের ব্যবসা। এর ফলে, প্রতি বছর আমবাগানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত, নতুন গড়ে উঠা বাগানগুলো মূলত বনেদি জাতের আমের চাষে মনোনিবেশ করছে, যেমন ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাত এবং আশ্বিনা জাতের হাইব্রিড গাছ বেশি পরিমাণে লাগানো হচ্ছে।

সাধারণত, মাঘের শেষে আম গাছে মুকুল আসার কথা থাকলেও, এবার এক ব্যতিক্রম ঘটেছে। পূর্বে, রাজশাহীতে আমের মৌসুমে 'অফ ইয়ার' এবং 'অন ইয়ার' নামে পরিচিত একটি ধারা ছিল, যেখানে 'অফ ইয়ার' এ ফলন কম এবং 'অন ইয়ার' এ ফলন বেশি হত। তবে, গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে রাজশাহীর গবেষক ও আম চাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই প্রথা ভেঙে গেছে। নিয়মিত পরিচর্যার ফলে, এখন প্রতি বছরই রাজশাহীর সব বাগানে আমের ভালো ফলন হচ্ছে এবং উৎপাদন বাড়ছে।

অতিরিক্তভাবে, এ বছর পৌষের শেষেও রাজশাহীর অনেক আমবাগানে আগাম মুকুল দেখা গেছে। যদিও অতীতে গাছজুড়ে মুকুলের আধিক্য থাকত, এ বছর তা ব্যতিক্রমী। গাছে মুকুলের সংখ্যা অল্প। গত বছরগুলোতে মুকুলের প্রাচুর্যের দৃশ্যের পরিবর্তে, এ বছরের বাগানগুলো দেখে চাষিদের মনে আশার প্রদীপ জ্বালাতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ আমের মুকুল ও কৃষকের স্বপ্ন একই সুতোয় বাঁধা। তাই, প্রতিদিনই চলছে আম গাছের যত্ন। গাছের গোড়ায় মাটি দিয়ে উঁচু করার মাধ্যমে সেচ দেওয়া হচ্ছে।

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আম গাছে মুকুলের প্রাচুর্য কম। চাষিরা বলছেন, শীতের কারণে মুকুল এখন কম দেখা গেলেও পরে আরও বাড়বে। তবে বৈজ্ঞানিক মহল কিছুটা সতর্ক বার্তা দিচ্ছে। তাদের মতে, শীতকাল সম্পূর্ণরূপে বিদায় নেওয়ার আগে আমের মুকুল আসা অত্যন্ত ইতিবাচক নয়। বর্তমানে প্রকৃতিতে মাঝে মাঝেই ঘন কুয়াশার সাক্ষী হচ্ছি আমরা। হঠাৎ হঠাৎ এই ধরণের ঘন কুয়াশা আমগাছের মুকুলের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে মুকুল ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যা পরবর্তীতে ফলনে প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী, ফাগুন মাসে ঘন কুয়াশার সম্ভাবনা খুবই কম হলেও, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি যদি বিরূপ আচরণ করে, তবে আমের মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মাঝে মধ্যে ঘন কুয়াশা নামলে মুকুলের ক্ষতি হয়। পাউডারি মিলডিউ নামক রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশিরভাগ মুকুলই ঝরে পড়ে। এতে আক্রান্ত বাগান মালিকরা ক্ষতির মুখে পড়বেন। তবে, কী পরিণাম আসবে তা শেষ পর্যন্ত দেখে না বলা বেশ কঠিন।

রাজশাহীর পবা উপজেলার আম ব্যবসায়ী আবদুর রহিম বলেছেন, একবার ফলন হলে প্রায় সারা বছর আমবাগানের পরিচর্যায় তাদের সময় কেটে যায়। সাধারণত, ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যভাগে আমের মুকুল আসার কথা, কিন্তু এবার আগে ভাগেই মুকুল এসেছে।

তানোর উপজেলার বাঁধাইড় গ্রামের আম ব্যবসায়ী আব্দুল বারি জানান, বাগান থাকলেই গাছের পরিচর্যা করতে হবে। গাছের যত্ন না নিলে ভালো ফলনও আশা করা যায় না। এদিকে ফের সার, কীটনাশকের দাম বাড়ছে। পরিচর্যা খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে চিন্তা হচ্ছে। খরচ করে যদি আমের নায্য দাম না পাই তাহলে খরচ করায় বৃথা হয়ে যাবে। তাছাড়া এবার আমের মুকুল কম আছে। এতে চিন্তা দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে।

বাঘা উপজেলার নারায়নপুর এলাকার চাষি আব্দুল জব্বার বলেন, আমরা যারা আম চাষে নির্ভরশীল, তাদের জন্য এই মুকুল সংকট এক বড় ধাক্কা। প্রতি বছর আমরা এই সময়ে আমের মুকুল দেখে আনন্দ পাই, কিন্তু এবার সেই আনন্দের জায়গাটা দুশ্চিন্তা দখল করে নিয়েছে। আমাদের সবার জন্য এটি একটি কঠিন সময়, বিশেষ করে যারা ছোট চাষি, তাদের জন্য। আমরা সবাই একত্রিত হয়ে এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে চাই এবং আশা করি, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তর আমাদের পাশে দাঁড়াবে। রাজশাহীর আম চাষিদের মধ্যে বর্তমান মুকুল সংকট ব্যাপক দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে আমের মুকুল রক্ষার জন্য, আগাম কীটনাশক প্রয়োগসহ গাছের যত্নে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন আমচাষি ও বাগান মালিকরা। মুকুল সুরক্ষিত রাখতে অনেকে গাছে গাছে ওষুধ স্প্রে করছেন। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে, এ বছর আমের বাম্পার ফলনের প্রত্যাশা করছেন বাগান মালিকরা।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বিভাগের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ৩৫% গাছে মুকুল এসেছে। এসব গাছের মুকুল রক্ষা ও যথাযথ পরিচর্যা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন জানান, এবার রাজশাহীতে ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমির আমবাগানে ২ লাখ ৬০ হাজার ১৬৪ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে, আম রফতানিতে বৃদ্ধি প্রাপ্তি সম্ভব হবে।

 


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর