news2bdgazette@gmail.com বৃহঃস্পতিবার, ৯ই মে ২০২৪, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপদ নয় রাজশাহীর মার্কেট-সুপারমল, অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন

জাতীয় ডেস্ক

প্রকাশিত:
৫ মার্চ ২০২৪, ১৮:২৫

ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীর মার্কেট ও সুপারমলগুলোতে অগ্নি নিরাপত্তার নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এলাকাবাসি। বহু মার্কেট ও শপিং মলে পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ক্রেতা ও দোকানিরা সবসময় বড় ধরণের দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই অগ্নি নিরাপত্তা বিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে উদাসীন বা অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, যা বৃহত্তর ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। রাজশাহী শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত মার্কেট ও সুপারমলগুলো অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপদ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অভাবে চিহ্নিত হয়েছে। জরুরি নির্গমন পথ, অগ্নি নির্বাপক, ধোঁয়া সনাক্তকারী যন্ত্র এবং জলের স্প্রিংকলার সিস্টেম মতো প্রাথমিক অগ্নি নিরাপত্তা উপাদানগুলোরও ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া, নিয়মিত অগ্নি নিরাপত্তা মহড়া এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ নাই বললেই চলে।

জানা গেছে, রাজশাহীর পাঁচটি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বহন করতে করতেই দিন পার হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের বারবার সতর্কবাণীর পরেও, মার্কেটগুলোর ঝুঁকি মোচনে কোনো প্রকার উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিস দ্বারা মার্কেটগুলোর সামনে সতর্কতামূলক ব্যানার টানানো হলেও, রাতারাতি তা খুলে ফেলা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতা হচ্ছে এই ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো পুনর্নির্মাণ বা সংস্কারের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার মূল কারণ।

মার্কেট পাঁচটি হলো- নগরীর সাহেববাজারের আরডিএ মার্কেট, রাজশাহী নিউমার্কেট, হড়গ্রাম নিউমার্কেট, সোনাদীঘি এলাকার সমবায় মার্কেট এবং নগরীর সাহেববাজার কাপড়পট্টি। এর মধ্যে আরডিএ মার্কেট রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) অধীনে, সমবায় মার্কেট সমবায় বিভাগের, রাজশাহী নিউমার্কেট ও হড়গ্রাম নিউমার্কেট রাজশাহী সিটি করপোরেশনের এবং কাপড়পট্টি সাধারণ ব্যবসায়ীদের দোকানপাট নিয়ে গড়ে উঠেছে।

রাজশাহী বিভিন্ন মার্কেট ও সুপার মল ঘুরে দেখা গেছে, বহু মার্কেটে অগ্নি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ অমান্য করা হচ্ছে। মার্কেট ও সুপারমলগুলোর অধিকাংশের মধ্যে অগ্নি নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেই এবং অগ্নি সতর্কতা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। এই পরিস্থিতিতে, স্থানীয় প্রশাসন ও অগ্নি নিরাপত্তা বিভাগের উচ্চতর মনোযোগ এবং কঠোর পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রয়োজন। নিরাপদে কেনাকাটা ও ব্যবসা পরিচালনার জন্য এই মার্কেট ও সুপারমলগুলোতে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি এবং নিয়মিত মনিটরিং জরুরি বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।

সচেতন নাগরিকরা বলেন, নিরাপদে কেনাকাটা এবং ব্যবসা পরিচালনার জন্য রাজশাহীর মার্কেট ও সুপারমলগুলোতে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি সত্যিই অপরিহার্য। আমরা যখন কেনাকাটা করতে যাই, তখন আমাদের মনে একটি নিরাপদ পরিবেশের প্রত্যাশা থাকে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, এসব মার্কেট ও সুপারমলে জরুরি নির্গমন পথ অবরুদ্ধ বা অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জামাদির অভাব থাকে। এমনকি অগ্নি সংক্রান্ত দুর্ঘটনা মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণের অভাবও প্রায়ই দেখা যায়।

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. জামাত খান বলেন, আরডিএ নগর উন্নয়নে যারা কাজ করে, যাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তাদেরই নিজস্ব একটা মার্কেট আছে, তাদের নিজস্ব মার্কেটেই অগ্নি নির্বাপক কোন ব্যবস্থা তারা রাখেনি। হ্যাঁ এছাড়া যে সমস্ত মার্কেট বা শপিং মল গুলো রয়েছে সে সমস্ত মার্কেটগুলোতেও খুব অল্প সংখ্যক অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থাপনা রয়েছে। আ যেসব মার্কেটগুলো রয়েছে সেই মার্কেট গুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তৈরি হয়েছে। আর যেখানে ফায়ার সার্ভিস বা পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন আইন বা নোটিশ মানেনি।

বিশেষ করে রাজশাহী নিউ মার্কেটের পাশে একটি পুকুর ছিল সেটিও ভূমি দস্যুরা পুকুরটিকে খেয়ে নিয়েছে। সুতরাং আমি মনে করেছি রাজশাহীতে আর ডি মার্কেট নিউ মার্কেটসহ যে সমস্ত মার্কেটগুলো রয়েছে সেগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এসব মার্কেটগুলোতে যে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ব্যাপক ক্ষতি হবে বলে আমি মনে করি। এছাড়া ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কাও করেন তিনি। এই প্রেক্ষাপটে, ব্যবসায়ী সমাজ ও ক্রেতাদের মধ্যে অগ্নি নিরাপত্তা সচেতনতা বাড়ানো এবং নিরাপদ কেনাকাটার পরিবেশ নিশ্চিত করা অপরিহার্য বলে মনে করছেন জামাত খান।

সাহেব বাজার এলাকার সড়কটি সম্প্রসারণের সময় ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করে ১৯৯০ সালে আরডিএ মার্কেটে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। তিনতলা এই মার্কেটে ১ হাজার ৯৫২টি দোকান রয়েছে। এই মার্কেটের তিন পাশেই সরু রাস্তা রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার কোন উপায় নেই। সামনে প্রশস্ত রাস্তা থাকলেও প্রধান ফটকের কারণে মার্কেটের ভেতরে গাড়ি ঢুকতে পারবে না। মার্কেটটিতে মুদি দোকান,  কাপড়, কসমেটিক্স থেকে ক্রোকারিজ ও ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানও রয়েছে। ফলে মার্কেটটিতে অগ্নিকাণ্ডের চরম ঝুঁকি রয়েছে।

গত ৮ জানুয়ারি রাতে মার্কেটের প্রধান ফটক সংলগ্ন বাইরের অংশে একটি মুদি দোকানের দোতলার গুদামে আগুন লাগে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট প্রধান সড়ক থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এই আগুন খাঁচার মতো ঘিঞ্জি মূল মার্কেটে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং বহু মানুষের হতাহতের আশঙ্কা ছিল।

অগ্নিকাণ্ডের চরম ঝুঁকি থাকায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কয়েক বছর আগেই আরডিএ মার্কেট ভেঙে ফেলতে সুপারিশ করে। তবে মার্কেটটি এখনও ভাঙা হয়নি। এই মার্কেটে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ কেনাকাটা করেন। ঈদের সময় মার্কেটের ভেতরে পা ফেলার জায়গা থাকে না। তাই ফায়ার সার্ভিস প্রতিবছরই ঈদের সময় ক্রেতাদের সতর্ক করে মার্কেটের সামনে ব্যানার টানিয়ে দেয়। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা চলে গেলেই ওই ব্যানার গায়েব হয়ে যায়।

সর্বশেষ, গত ১৭ এপ্রিল আরডিএ মার্কেট, রাজশাহী নিউমার্কেট, হড়গ্রাম নিউমার্কেট, সমবায় মার্কেট এবং সাহেববাজার কাপড়পট্টি অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যানার টানিয়ে দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ব্যানারে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘অগ্নিনিরাপত্তার দিক দিয়ে এই মার্কেট অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে।’ এই দিনে, সকলকে সতর্ক করে মাইকিং এবং প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়েছিল।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের রাজশাহী বিভাগের উপ-পরিচালক ওহিদুল ইসলাম বলেন, রাজশাহীর এই মার্কেটগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে অগ্নিনির্বাপণের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই। আমরা বারবার চিঠি দিয়েও মার্কেট কর্তৃপক্ষকে সচেতন করেছি, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আরডিএ মার্কেটের কাছে কোনো পুকুর নেই, যা অগ্নিকাণ্ডের সময় পানির অভাব সৃষ্টি করবে। এছাড়া, মার্কেটের সিঁড়িগুলোতে মালামাল রাখা হয়, যা আগুন লাগলে মানুষের নিরাপদে নেমে আসার পথে বাধা সৃষ্টি করবে। মার্কেটের ভেতরে বৈদ্যুতিক তারের অব্যবস্থাপনা রয়েছে, যা সহজেই দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। এসব কারণে এই মার্কেটগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, আরডিএ একাধিকবার তাদের মার্কেট ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা করেছে, কিন্তু ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি সম্পর্কে আরডিএ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা মানতে চান না। নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরাও একই অবস্থানে আছেন। আরডিএ মার্কেটের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, মার্কেট ভাঙা হলে তাদের পুনর্বাসনের ঠিক নেই। নতুন মার্কেট নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের ব্যবসার অনিশ্চয়তা রয়েছে, যা মূলত তাদের বিরোধিতার কারণ।

আরডিএ’র চেয়ারম্যান জিয়াউল হক বলেন, মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সম্প্রতি আমরা প্রায় ২০০টি ফায়ার এক্সট্রিংগুইসার দিয়েছি। পাশ দিয়ে বিদ্যুতের লাইন আছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সব সতর্কতা অবলম্বনের জন্য আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থার সঙ্গেও কথা বলেছি। আমাদের সতর্কতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ চলমান। মার্কেটটা ভাঙার পরিকল্পনা আছে। সেটা নিয়েও কাজ চলছে।

ফায়ার সার্ভিস কোন মাপকাঠিকে অযুক্তিক মন্তব্য করে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার বলেন, ফায়ার সার্ভিস কোন মাপকাঠিতে এবং কীভাবে এসব মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারব না। কিন্তু অনেক সময়, ব্যবসায়ীরা এক ধরনের দোকান নিয়ে শুরু করে অন্য ধরনের ব্যবসা করেন। অবকাঠামোর আকারও পরিবর্তন করে ফেলেন। এমন পরিবর্তন ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। হড়গ্রাম নিউমার্কেটে এ ধরনের ঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে। বিস্তারিত পরীক্ষা না করে বলা সম্ভব নয়। তবে আমার মতে, রাজশাহী নিউমার্কেট খুব একটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয় না। এর তিন পাশে বড় বড় রাস্তা আছে এবং ভবনটি মাত্র দুই তলা বিশিষ্ট। এরপরও, এটিকে ভেঙে একটি অত্যাধুনিক মার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর