news2bdgazette@gmail.com সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

রঙ্গিন মাছ চাষে দুই ভাইয়ের স্বপ্নযাত্রা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত:
২৬ মার্চ ২০২৪, ১৫:২৫

ছবি: সংগৃহীত

দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, নতুন ধারণা, এবং অদম্য পরিশ্রমের মাধ্যমে সফলতা অর্জন সম্ভব এমনটায় প্রমান করেছেন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার দুই ভাই রহমত আলী ও খালেদ মাহমুদ সুজন। তাদের হাত ধরে উঠে এসেছে এক নতুন বিস্ময়। 'আরএস কালার ফিস ফার্ম' নামে তাদের এই মাছের খামার যেন রঙিন মাছের এক স্বপ্নলোক, যেখানে লাখো লাখো রঙিন মাছের বর্ণালী জলের তলে জীবনের এক অন্য রূপ ফুটে উঠেছে। যেখানে ইতিহাস ও সমৃদ্ধ কৃষি মিলে মিশে এক সোনালি অধ্যায় রচিত হয়েছে। রঙ্গিন মাছ চাষে দুই ভাইয়ের স্বপ্নযাত্রা যেন একটি অনুপ্রেরণামূলক গল্প।

একসময় তারাও স্বাভাবিক চাকরির খোঁজে ছিলেন, কিন্তু তাদের মনের মধ্যে সবসময় একটি স্বপ্ন লালন করতেন—সেটি হল তাদের নিজস্ব ব্যবসা গড়ে তোলা। তাদের মনের মধ্যে সবসময় একটি বিশেষ আগ্রহ ছিল মাছ চাষের প্রতি, বিশেষ করে রঙ্গিন মাছের চাষে।

রঙ্গিন মাছ, যা অ্যাকোয়ারিয়ামের শোভা বৃদ্ধি করে, তাদের চোখে শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বরং একটি স্বপ্ন সাধনের মাধ্যম। সেই সঙ্গে, তারা জানতেন যে রঙ্গিন মাছের চাষ একটি বিশেষ বাজার আছে যেখানে চাহিদা সর্বদা উচ্চ, কিন্তু সরবরাহ সীমিত। এই বিশেষ নিচের বাজারে প্রবেশ করে তারা নিজেদের এক নতুন পরিচয় দিতে চেয়েছিলেন।

তাদের যাত্রাপথ সহজ ছিল না। তাদের মোকাবেলা করতে হয়েছিল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, প্রাথমিক ব্যর্থতা, এবং অনেক সমালোচনা। কিন্তু তাদের পরস্পরের প্রতি অবিচল বিশ্বাস এবং তাদের স্বপ্নের প্রতি অটল থাকার ক্ষমতা তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই চাষের প্রয়াস কেবল বাণিজ্যিক লাভের গল্প নয়, এটি হল স্বপ্ন সাকারের এক অভিযাত্রা। এই দুই ভাই নিজেদের অদম্য সাহস ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, প্রতিকূলতাকে জয় করে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তাদের এই খামার আজ  শুধু চারঘাটে নয়; বরং সারা বাংলাদেশের মৎস্য চাষ শিল্পের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

পরানপুর গ্রামের এই ফার্মে, প্রতিটি মাছ এক একটি বর্ণিল গল্প বুনে চলে, এবং এসব গল্প ঢাকাসহ বাংলাদেশের বুকে বুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে আনন্দের বার্তা। এই উদ্যোগের মূলে রয়েছে দুই ভাইয়ের অন্বেষণের আগ্রহ ও গভীর গবেষণা, যা দেখিয়েছে পরিকল্পনা ও সঠিক যত্নের মাধ্যমে কীভাবে একটি সফল বাণিজ্যিক খামার গড়ে তোলা যায়।

'আরএস কালার ফিস ফার্ম' এখন চারঘাটের এক মনোরম দৃশ্যপট। মাছ চাষী ও উদ্যোক্তারা দেশের চারকোনা থেকে এখানে আসেন শিক্ষা নিতে এবং অনুপ্রেরণা গ্রহণ করতে। দুই ভাই এখন মৎস্য চাষের উপর সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজন করেন, যাতে অন্যান্যরা এই ক্ষেত্রে আরও দক্ষ ও সফল হতে পারেন।

‘আরএস কালার ফিস ফার্ম’ তাদের অভিনব পদ্ধতি ও গভীর আগ্রহের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা যখন মিলিত হয়, তখন অসাধারণ সাফল্যের পথ উন্মুক্ত হয়। এই খামার শুধুমাত্র রঙিন মাছের চাষে নয়, বরং পরিবেশ বান্ধব এবং টেকসই মৎস্য চাষের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে কাজ করছে।

এই ফিস ফার্মটি তার সাফল্যের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে, উদ্ভাবন ও উদ্যমের সমন্বয়ে কীভাবে অসাধারণ সাফল্য অর্জিত হয়। রহমত আলী ও খালেদ মাহমুদ সুজনের এই উদ্যোগ কেবল তাদের নিজেদের জন্য এক অনন্য সাফল্যের গল্প নয়, এটি বাংলাদেশের মৎস্য চাষ শিল্পে এক নতুন দিশা নির্দেশনা প্রদান করে।

ফার্মের উৎপাদিত বর্ণিল মাছ দেশজুড়ে বিক্রি হচ্ছে, এবং তারা স্বপ্ন দেখছেন ভবিষ্যতে বিদেশেও এই মাছ রপ্তানি করতে। তাদের এই আগ্রহ ও উৎপাদন বৃদ্ধির প্রতি উদ্যোগে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর কারিগরি সহায়তা ও উৎসাহ প্রদানে এগিয়ে এসেছেন।

‘আরএস কালার ফিস ফার্ম’ ঘুরেদেখা যায়, সেখানে ছোট থেকে বড় পর্যন্ত প্রায় ২০ জাতের বিদেশি বর্ণিল মাছের প্রায় লক্ষাধিক সংখ্যা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য মাছের জাতের মধ্যে রেড ইয়ার গাপ্পি, রেড টেল প্লাটিনিয়াম গাপ্পি, এলবিনো ফুল রেড বা রেড মস্কো, ব্লাক মস্কো, সান্তাক্লোজ, হোয়াইট ডক্রডো, রেডিয়াম মুনতেল বেলুনমালি, লং ফিন জেব্রাসহ নানান প্রজাতির মাছ। এদের মধ্যে রেড ইয়ার গাপ্পি ও এলমিনো কৈ প্রতি পিস ১৫০০-২০০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়।

কথা হয় বড়ভাই রহমত আলীর সাথে। তিনি জানান, শখের বশে ২০১৭ সালে ছোট ভাই সুজনকে নিয়ে তিনি বর্ণিল মাছের চাষ শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে জেলা শহর ও ঢাকা থেকে মা মাছ সংগ্রহ করে ছোট পরিসরে নিজেদের আঙ্গিনায় ৪টি স্যানেটারি রিং ব্যবহার করে মাছ চাষ করতেন। বাজারে চাহিদা বাড়ার কারণে বছর পেরোতেই তিনি সাফল্যের দেখা পান। রঙিন মাছের চাষ ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক প্রমাণিত হওয়ায়, তিনি প্রাইভেট চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাণিজ্যিক ভাবে মাছ চাষে মনোনিবেশ করেন।

চাহিদা আরও বাড়লে, উপজেলা মৎস্য দফতরের আর্থিক সাহায্য নিয়ে তিনি জেলার সবচেয়ে বড় রঙিন মাছের উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সরাসরি থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, এবং সিঙ্গাপুর থেকে মাছের পোনা আমদানি করে রেনু উৎপাদনের মাধ্যমে পোনা সংগ্রহ করে মাছ উৎপাদন করছেন।

কথা হয় ছোট ভাই খালেদ মাহমুদ সুজনের সাথেও। তিনি জানান তার ফার্মে রঙিন মাছ চাষ করার গল্প। তিনি বলেন, ঢাকার কাটাবন এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশের প্রায় সব জেলা ও উপজেলায় আরএস কালার ফিস ফার্মের রঙিন মাছ বিক্রি করা হয়। রঙিন মাছ বিক্রি করে তিনি প্রতি মাসে প্রায় লক্ষাধিক টাকা আয় করেন।

তিনি আরও জানান, উপজেলা মৎস্য দফতরের সাহায্যে সরকার থেকে সহজ শর্তে ঋণ এবং কারিগরি সহায়তা পাওয়া গেলে, দেশীয় প্রক্রিয়ায় মানসম্পন্ন রঙিন মাছের উৎপাদন এবং তার পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব। এতে করে স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওয়ালী উল্লাহ মোল্লাহ বলেন, রঙিন মাছের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বাড়ছে। দেশ ও বিদেশে এই মাছের চাহিদা বেড়ে চলেছে বলে অনেকেই মাছ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।

উপজেলা মৎস্য দফতর এই উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য ইতিমধ্যে এনএপিপি প্রকল্পের আওতায় ২০২১-২২ অর্থবছরে হ্যাচারি উন্নয়নে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা সহায়তা প্রদান করেছেন।


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর