news2bdgazette@gmail.com সোমবার, ২০শে মে ২০২৪, ৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ে ব্যস্ত বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত:
৫ মে ২০২৪, ১৮:২৭

ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা এখন পুরোপুরি ব্যস্ত তাদের বোরো ধান কাটা এবং মাড়াইয়ের কাজে। শরতের এই সময়টাতে তাদের এই ব্যস্ততা আরো বেড়ে গেছে। মাঠভরা সবুজ ধানের শীষ এখন কৃষকদের মুখের হাসি। তবে যন্ত্রের অভাবে এখনও শ্রমিকের চাহিদা অটুট রয়েছে এই অঞ্চলে।

বোরো মৌসুমের এই শেষ পর্বে ধান কাটা এবং মাড়াই করে খাদ্য ভাণ্ডার পূরণের চেষ্টায় রাত-দিন এক করে দিয়েছেন কৃষকরা। গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই মাড়াই কাজ। আবহাওয়া সহায়ক হলেও ফলনে অনিশ্চয়তা এখনো তাদের মনে দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করেছে।

তীব্র গরমের মাঝেও ধান কাটা মাড়াই শুরু হয়েছে। মাঠজুড়ে কৃষক-শ্রমিকদের ব্যস্ততার শেষ নেই। আধুনিক যন্ত্রের ব্যপক পরিচিতি ও প্রচলন না ঘটার কারণে এখনও রয়েছে শ্রমিকের চাহিদা। গভীর রাত পর্যন্ত চলছে ধান মাড়াইয়ের কাজ। তবে ধানের গাছপাত ভাল হলেও ফলন বিপর্যয়ের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন কৃষকরা।

কৃষকরা বলছেন, চলতি মৌসুমে বেশিরভাগ জমিতেই উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের চাষ করা হয়েছে। মৌসুম শুরুর পর থেকে এ অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃস্টিপাত না হওয়ার কারণে স্থানীয় জাতের ধান ভাল হয়নি। তাহাড়া ধানের গাছ ভালো হলেও চাষিদের দুশ্চিন্তা এখনো রয়েছে। আবহাওয়া যদি ভালো থাকে তবে ফলনও ভালো হবে এমনটা আশা করেন তারা।

মোহনপুর উপজেলার কেশরহাট পৌর এলাকার বাকশৈল মহল্লার কৃষক আবদুস সাত্তার জানিয়েছেন আউশ ধান কাটা মাড়াই শেষ পর্যায়ে। এবার খরা এবং পোকার আক্রমণের কারণে ফলন কিছুটা কম হয়েছে। আশা ছিল প্রতি বিঘায় ২০ মণ ধান ফলবে কিন্তু প্রতি বিঘায় ফলন হয়েছে ১৬ থেকে ১৭ মণ।

হরিদাগাছি মহল্লার কৃষক ওবায়দুর রহমান জানিয়েছেন ধানের গাছপাত খুব ভাল হয়েছিল। আশা ছিল ভাল ফলন হবে। তবে জমিতে গিয়ে দেখছি শীষ হালেনি। অর্ধেক ধান চিটা। এ থেকে ধারনা করছি ফলন ভাল হবে না। আবদুর রাজ্জাক নামের অপর একজন কৃষক জানিয়েছেন ধান কাটা-মাড়াইয়ের মন খুব খারাপ। বেশি ভাগ ধান মরা। ফলন অর্ধেক হয়েছে। পোকা লাগছিল কিন্তু বুঝতে পারিনি।

কৃষি বিভাগের দাবী কিছু কৃষকদের অসাবধনতার কারণে দুই এক স্থানের খেতে নতুন রোগ এবং ইঁদুরের সামান্য ছিল। বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির ফলে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের ভাল ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে।

বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ে ব্যস্ত বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২০২৪ মৌসুমে ৭০ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে, যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন চাল।

চাষিরা জিরা, কাটারি, বিআর-২৬ ও ২১, ব্রি-২৮, ৫৬, ৬৫, ৮২, ৮৮, ৮৬, ৮৯, ৯২ বিনা-২৫, বঙ্গবন্ধু-১০০ পারিজা ও হাইব্রিড হীরা জাতের ধান চাষাবাদ করেছেন। এখন পর্যন্ত বরেন্দ্র অঞ্চলে শতকরা প্রায় ৫ ভাগ জমির ধান কাটা-মাড়াই সম্পন্ন হয়েছে। আর ৪ দশমিক ৮২ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৮ হাজার ৬০০ হেক্টর জমি, যেখানে উৎপাদন হয়েছিল ৩ লাখ ৩২ হাজার ৪৩৯ মেট্রিক টন চাল। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ১ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন এবং উৎপাদনে বেড়েছে ১৩ হাজার ৬৩১ মেট্রিক টন।

২০২১-২২ অর্থবছরে ৬৫,৮৩৪ হেক্টর জমিতে মোট ২ লাখ ৭১ হাজার ১৭১ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়েছে।

পূর্ববর্তী বছরে অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৬ হাজার ৭৩২ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৮৯ হাজার ৯৮৮ মেট্রিক টন।

২০১৯-২০ অর্থবছরে, ৬৬ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে ধানের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৮৬ হাজার ৯৮৩ মেট্রিক টন।

এরপরের বছর, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭০ হাজার ১০৮ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ২ লাখ ৯৭ হাজার ৬৬৩ মেট্রিক টন।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৯ হাজার ২০৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ছিল লাখ ৯৩ হাজার ২৬৫ মেট্রিক টন।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৭ হাজার ২৬৩ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৮৫ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৬ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৬২ হাজার ৭৮৮ মেট্রিক টন।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬৯ হাজার ৭৭৮ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হয় ২ লাখ ৯৪ হাজার ০১৫ মেট্রিক টন ধান।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ০৮৬ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ৫৪৪ মেট্রিক টন এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ০৪৫ হেক্টর জমিতে মোট ২ লাখ ৭৬ হাজার ৩২৬ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছিল।

এই সময়কালে হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪.০৬ মেট্রিক টন থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেড়ে ৪.৮৫ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।

স্থানীয় কৃষি অফিসের মতে, বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে যাতে তারা আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে আরও দক্ষ হতে পারেন এবং তাদের উৎপাদন খরচ কমাতে পারেন।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক ও জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মোছাঃ উম্মে ছালমা বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা বর্তমানে বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ে ব্যস্ত। এই অঞ্চলে বোরো ধানের চাষ অত্যন্ত জনপ্রিয় কারণ এখানে মাটির গুণাগুণ এবং জলাবায়ু ধান চাষের জন্য উপযুক্ত। কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে আমরা লক্ষ্য করছি, এ বছর ধানের ফলন বেশ ভালো হয়েছে। কৃষকরা আধুনিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তি গ্রহণ করে ফলন বৃদ্ধির চেষ্টা করেছেন। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের শ্রমিকের অভাব এবং মজুরির হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা তাদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি করেছে।

তিনি বলেন, আমরা কৃষকদের উপর বাজারজাতকরণের কৌশল উন্নত করার জন্য কাজ করছি, যাতে তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পান। কৃষকদের আর্থিক সাহায্য ও ঋণের সুবিধা প্রদান,ও লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানোর চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ফজলুল ইসলাম বলেন, দাবদাহের কারণে শস্যের ফলনে কিছুটা কমতি দেখা দিতে পারে, তবে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। এ বছর বোরো ধানের আবাদ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি হবে, যা কৃষকদের জন্য খুবই ভালো খবর। এছাড়া বোরো ধানের জমিতে এবার কোনো ধরনের পোকামাকড় বা রোগবালাইয়ের আক্রমণ না থাকায় ধানের ফলন অনেক ভালো হবে।

তিনি বলেন, ভালো ফলনের প্রভাব শুধু কৃষকদের উপরই নয়, এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দেশে চালের দাম স্থিতিশীল থাকতে পারে এবং এতে করে সাধারণ মানুষের উপর বাজারের মূল্যবৃদ্ধির চাপ কম পড়বে। অতিরিক্ত ফলনের কারণে বাজারে চালের যোগান বেড়ে যাবে, যা খুচরা বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। এই বছরের উন্নত ফলন আগামী দিনগুলিতে কৃষি গবেষণা ও কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়নে নতুন উৎসাহ যোগাবে।


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর