news2bdgazette@gmail.com সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

যে 'যুদ্ধ' আসলে 'গণহত্যা'

ড. মাহফুজ পারভেজ

প্রকাশিত:
৩১ জানুয়ারী ২০২৪, ১৮:১৪

ছবি: সংগৃহীত

গাজায় যুদ্ধ হচ্ছে বলা হলেও সেখানে আসলে চলছে গণহত্যা। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বড় বড় শিরোনামে খবর প্রকাশ হচ্ছে 'ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ' নামে। বাস্তবে চলছে ইসরায়েলের একতরফা আক্রমণ, যাতে তিন মাসেরও কম সময়ে নিহত হয়েছেন ফিলিস্তিনের ২৭ হাজার হাজার সাধারণ নাগরিক।

যুদ্ধ হলে উভয়পক্ষের সৈন্যদের আহত বা নিহত হওয়ার তথ্য প্রকাশ পেতো। কিন্তু ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজা থেকে প্রাপ্ত খবরে থাকছে বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা, শিশুদের আর্তনাদের ছবি, নারী ও বৃদ্ধদের হাহাকার।

গাজার বাইরে থেকে পৃথিবীর বহু মানুষ এই মানবিক বিপর্যয়ের আলোকে যুদ্ধকে দেখছেন। কিন্তু সেই যুদ্ধকে তার আসল প্রকৃতি অনুসারে গণহত্যায় সংজ্ঞায়িত করছেন না। সাধারণত উভয়পক্ষের যেরূপ যুদ্ধ হয়, তা গাজায় অনুপস্থিত। একপেশে হামলাকে যুদ্ধ বলা যায় না। তথাপি একে যুদ্ধ বলা হচ্ছে গণহত্যাকে ঢেকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। পশ্চিমা মিডিয়া ও ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডা একটি নৃশংস গণহত্যাকে যুদ্ধের মোড়কে অর্ধ-সত্য অবয়বে তুলে ধরছে।

প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে হামলাকারী চক্র আরও অনেক কিছুকেই চেপে রাখছে। তারা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, যাতে গাজায় মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রকৃত চিত্র দেখা অসম্ভব হয়। কারণ, ঘটনাপ্রবাহের প্রকৃত চিত্র বিস্তারিত ভাবে জানা যাচ্ছে না। ইন্টারনেট না থাকা ও মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক কাজ না করায় তৈরি হয়েছে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকদের সেখানে প্রবেশ সীমাবদ্ধ করা হয়েছে আর স্থানীয় সাংবাদিকরা মোকাবিলা করছেন জীবনের হুমকির চ্যালেঞ্জ। এসব নানা কারণেই গাজায় ভয়াবহতার প্রকৃত চিত্র থাকছে দৃষ্টির বাইরে। সেখানে দেখানো হচ্ছে একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি আর আড়াল করা হচ্ছে বর্বর গণহত্যা।

মঙ্গলবার দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এসব বিরূপতার তথ্য উঠে আসে। এতে বলা হয়, গাজায় আলোকচিত্রীদের তোলা কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়; পাশাপাশি অল্প সংখ্যক সাক্ষ্যপ্রমাণও মেলে। তবে যারা এসব তথ্য সংগ্রহ করছেন, তারা কাজ ছেড়ে দেওয়া বা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। গাজা থেকে সংবাদ প্রকাশ করা স্থানীয় সাংবাদিকদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মিডিয়ার পক্ষে সাফ জানানো হয়েছে, গাজার আসল খবর আমরাও জানি না!

কারণ, ইসরায়েলি হামলা অকাতরে সাধারণ মানুষ যেমন মারা যাচ্ছে, তেমনিভাবে নিহত হচ্ছেন সাংবাদিকসহ পেশাজীবীগণ। বহু সাংবাদিক ইসরায়েলি হামলায় গত তিন মাসে গাজায় মৃত্যুবরণ করেছেন। সর্বশেষ খবরে, গাজার সাংবাদিক ইসমাইল আল-দাহদৌ ইসরায়েলের নৃশংসতায় ছোট্ট নাতিসহ পরিবারের সব সদস্য হারিয়েছেন। বেঁচে ছিলেন তাঁর এক ছেলে। সম্প্রতি ইসরায়েলের হামলায় তিনিও নিহত হয়েছেন। এ মাসে এক ইনস্টাগ্রাম পোস্টে দাহদৌ সাংবাদিকতা থেকে অবসর নেওয়ার ঘোষণা দেন।

তিনি জানান, অনেকবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছেন; তাঁর জীবন এখন ঝুঁকিতে। এ পৃথিবী মানবতার মানে বোঝে না; এটা (ইসরায়েলের হামলা) থামাতে তারা কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।

গত ৭ অক্টোবর সংঘাত শুরুর পর অন্তত ৭৬ ফিলিস্তিনি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। সাংবাদিকদের সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী কাজ করা সংগঠন দ্য কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস বলছে, ১৯৯২ সালের পর যে কোনো বছরের তুলনায় গত ১৬ সপ্তাহে অনেক বেশি সাংবাদিক ও জরুরি সহায়তা সরবরাহে নিয়োগ করা অনুবাদক, গাড়িচালক ও মধ্যস্থতাকারী নিহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনিয়ান জার্নালিস্ট সিন্ডিকেট বলছে, ‘প্রেস’ লেখা ভেস্ট পরা অবস্থায় গাজার অন্তত ২৫ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।

সিএনএন জানায়, গাজার বাসিন্দারা চরম খাদ্যাভাব ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে রয়েছেন। তারা ঘাস খাওয়া ও দূষিত পানি পানে বাধ্য হচ্ছেন। ৩৮ বছরের হানাদি গামাল সাইদ আল জামারা বলেন, কেবল ঘুমই পারে তাঁর সন্তানদের চরম ক্ষুধা থেকে রক্ষা করতে। সাত সন্তানের মা আল জামারাকে দক্ষিণ গাজার রাফার কর্দমাক্ত রাস্তায় খাবার ভিক্ষা করতে দেখা যায়। তিনি বলেন, দিনে মাত্র একটি বার তিনি তাঁর সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে চান। তাঁর স্বামী ক্যান্সার ও ডায়াবেটিসের রোগী। আল জামারা বলেন, তাঁর সন্তানদের মুখ হলুদ হয়ে গেছে। তাদের প্রায়ই ডায়রিয়া হচ্ছে।

কার্যত গাজা দুর্ভিক্ষের দিকে এগোচ্ছে। গাজার বাসিন্দারা বলছেন, তারা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছেন। তারা গণহত্যার সম্মুখীন। যুদ্ধের নামে সুপরিকল্পিত ভাবে তাদের নির্বংশ করা হচ্ছে। জাতিগত নিধনের এমন ভয়ঙ্কর প্রকাশ মানবতার জন্য সত্যই বড় বেদনার। গাজায় হাজারো এতিম শিশুর আর্তনাদে বাতাস ভারাক্রান্ত, যা সেখানে যুদ্ধের ছদ্মাবরণে গণহত্যার সত্যতা প্রমাণ করে।

এসব শিশু জানে না, কেন তাদের পিতামাতাকে হত্যা করা হয়েছে। তারা তো যুদ্ধে যায় নি। ঘরে বা কর্মক্ষেত্রে ছিল। তবু ইসরায়েল যুদ্ধের নামে এদের হত্যা করেছে। এমন হাজারো শিশু পিতা-মাতাকে হারিয়েছে, যারা যুদ্ধের সঙ্গে মোটেও সংশ্লিষ্ট ছিল না। এতিম অনেক শিশু ইনকিউবেটরে ইসরায়েলি বোমায় মৃত্যুর অপেক্ষায়। তাকে বুকে তুলে আলিঙ্গন করার জন্য পিতা বা মাতা কেউই বেঁচে নেই।

ইসরায়েলের বিমান হামলায় মারা যান হান্না নামের এক মাতা। সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে তার একটি কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ করানো হয়। তার এই সন্তানকে গাজার কেন্দ্রস্থলে দিয়ের আল বালাহতে অবস্থিত আল আকসা হাসপাতালে দেখাশোনা করছেন নার্স ওয়ারদা আল আওয়াহদা। তিনি বলেন, এই সন্তানটিকে আমরা হান্না আবু আমশা নামে ডাকি। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। চলমান যুদ্ধে বহু শিশু এভাবে পিতামাতাকে হারিয়েছে। এসব পিতামাতা আসলে গণহত্যার শিকার।

যুদ্ধে যায় নি, এমন অনেক পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। তারা কেন যুদ্ধে মরবে? তারা তো সৈন্য বা যুদ্ধের অংশ নন। গণহত্যা পরিচালনা করছে বলেই যুদ্ধের বাইরের সাধারণ মানুষকেও হত্যা করছে ইসরায়েল। এবার এতিম শিশুরাও লালনপালনের অভাবে মারা যাবে। আসলে ইসরায়েল এমন এক যুদ্ধ করছে, যা গণহত্যার চেয়েও মারাত্মক।

গাজায় মোট জনসংখ্যা ২৩ লাখ। তার প্রায় অর্ধেকই শিশু। নিষ্ঠুর এই হামলায় এসব শিশুর জীবন তছনছ হয়ে গেছে। ইসরায়েল যতই বলছে তারা বেসামরিক জনগণের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ব্যবস্থা নিযেছে। কিন্তু ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, ১৮ বছরের নিচে বয়স এমন কমপক্ষে ১১ হাজার ৫০০ শিশু নিহত হয়েছে এই যুদ্ধে। আরও বেশি আহত হয়েছে। অনেকের জীবন বদলে গিয়েছে। এমন শিশুর যথার্থ সংখ্যা পাওয়া কঠিন।

ইউরো মেডিটারেনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটর নামের একটি অলাভজনক গ্রুপ বলেছে, কমপক্ষে ২৪ হাজার শিশু তার পিতামাতার একজনকে অথবা উভয়কেই হারিয়েছে। ১০ বছর বয়সী ইব্রাহিম আবু মোস পায়ে মারাত্মক ক্ষতে ভুগছে। তার পেটে আঘাত লেগেছে ক্ষেপণাস্ত্রের। বাড়িতে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করলে সে তাতে আহত হয়। মারা যান মা, দাদা ও বোন। তাদের কথা স্মরণ করে হাউমাউ করে কাঁদে সে।

হোসেনের পরিবারের কাজিনরা একসঙ্গে খেলাধুলা করতো। কিন্তু এখন তারা বালুতে দাফন করা কবরস্থানের কাছে গিয়ে বসে থাকে। স্কুলকে আশ্রয়কেন্দ্র বানানো হয়েছে। তার কাছেই দাফন করা হয়েছে মৃতদেহ। পরিবারের শিশুরা সবাই পিতা বা মাতাকে অথবা উভয়কেই হারিয়েছে। আল বুরেইজ শরণার্থী শিবিরে বসবাস করা আবেদ হোসেন বলেন, আমার মায়ের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ে। এতে তার দেহ খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়। কয়েক দিন ধরে বাড়ির ধ্বংসাবশেষের ভিতর থেকে তার দেহাবশেষ কুড়িয়ে বেড়াচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে বলা হয়, আমার ভাই, আঙ্কেল এবং পুরে পরিবারের সদস্যরা নিহত হয়েছে। এ খবর শুনে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। আবেদের চোখের চারপাশে কালো দাগ। রাতের বেলায় ঘুমিয়ে থাকলে ইসরাইলি গোলার শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ঘুম ভেঙে যায় তার। তখন খুব একা একা মনে হয় নিজেকে। আবেদ হোসেন বলে, মা-বাবা বেঁচে থাকতে আমি ঘুমাতে পারতাম। তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। তাই এখন আর ঘুমাতে পারি না। আমি সব সময় বাবার পাশেই ঘুমাতাম।

আবেদ হোসেন ও তার অন্য দুই ভাইবোনকে দেখাশোনা করেন তাদের দাদী। কিন্তু তাদের সবার জন্যই প্রতিটি দিন হয়ে উঠেছে কঠিন। আবেদ হোসেন বলে, আমাদের খাদ্য নেই। পানি নেই। সমুদ্রের পানি পান করার কারণে পেটে পীড়া হয়। রুটি বানানোর জন্য আটা মাখার সময় হত্যা করা হয়েছে কিনজা হোসেনের পিতাকে। এখন পিতার সেই মৃতদেহের ছবি তাকে তাড়িয়ে ফেরে। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তিনি মারা যাওয়ার পর বাড়ি নেয়া হয়েছিল দাফন করার জন্য। কিনজা হোসেন বলেন, বাবার চোখ সঙ্গে ছিল না। তার গলা কেটে গিয়েছিল। আমরা চাই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাক। কারণ, সবকিছুই খুব খারাপ হয়ে পড়েছে।

গাজায় বসবাসকারী প্রায় প্রতিজনই এখন জীবন রক্ষাকারী জিনিসপত্রের জন্য নির্ভর করে সাহায্যদাতাদের ওপর। জাতিসংঘের হিসাবে, কমপক্ষে ১৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক এজেন্সি ইউনিসেফ বলেছে, গাজার ১৯ হাজার শিশুকে নিয়ে তাদের উদ্বেগ বেশি। এসব শিশু এতিম। তাদেরকে দেখভাল করার কেউ নেই।

এমন মর্মন্তুদ পরিস্থিতিকে শুধু যুদ্ধ বলা সত্যের অপলাপ। গাজায় যা চলছে, তা পরিকল্পিত গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

 


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর