news2bdgazette@gmail.com সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

জেগে ঘুমিয়ে থাকা আর কতদিন?

মতামত ডেস্ক

প্রকাশিত:
১ মার্চ ২০২৪, ১৭:৫৩

ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর পুরান ঢাকায় নিমতলীতে মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে বহু মানুষের হতাহতের পর এক পরিবারের বেঁচে যাওয়া দুই কন্যাকে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কন্যাসম স্নেহে আগলে নিয়ে তাদের বিয়ে পর্যন্ত দিয়েছিলেন। অগ্নিকাণ্ড রোধে সেই সময়ে কড়া পদক্ষেপের কথা শুনেছি আমরা।

পুরান ঢাকা থেকে সকল রাসায়নিক গুদাম-কারখানা ঢাকার বাইরে সরিয়ে নিতে সরকারি নির্দেশনার বাস্তবায়ন না হওয়ার মাঝেই চুরিহাট্টায় ফের আগুনে বহু মানুষের প্রাণপ্রদীপ নিভে যাওয়া দেখতে হয়েছে আমাদের। অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডে বিপুল মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতে এরই মাঝে বেইলে রোডের গ্রিন কোজি কটেজে আগুনে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুতে ফের চিরচেনা দৃশ্যপটই আমরা দেখতে পাচ্ছি। একদিকে বহু পরিবারের স্বজনদের বুক ফাটা আর্তনাদ, অন্যদিকে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর একে অপরের ওপর দায় চাপানোর প্রতিযোগিতা! পুড়ে যাওয়া মানুষগুলোর লাশের উপর দাঁড়িয়েই আমরা দেখব তদন্ত কমিটি গঠন ও ভবিষ্যতের জন্য আরও কিছু আশ্বাস বাণী।

সহকর্মী কবির য়াহমদের ‘তোমার মৃত্যু নিছক সংখ্যা সকলে নিয়েছি মেনে’ শীর্ষক মর্মস্পর্শী লেখাটি পড়ে সত্যিই মনে হচ্ছে এসব মৃত্যুর মিছিল কেবলই একটি ‘সংখ্যা’ মাত্র। নইলে বেইলি রোডে দুর্ঘটনা কবলিত ভবনটির সিড়ি ব্লক করে সেখানে সিলিন্ডার রাখার মতো মৃত্যুফাঁদ দেখার মতো কি কেউ ছিল না? প্রতিটি দুর্ঘটনার পর যেসব কারণ আমরা জানতে পারি, দূর্ঘটনার পূর্বে সেসবের প্রতিকার করার কি কোন কর্তৃপক্ষ নেই? এ সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ করার জন্য সংশ্লিষ্টরা সব সময়েই কি ঘুমিয়ে থাকেন? তাদের সেই ‘জেগে ঘুমিয়ে থাকা’ ঘুম কবে ভাঙবে, তা আমরা জানি না। কিন্তু প্রতিটি ঘটনার মত গতকালের মর্মান্তিক এই অগ্নিকাণ্ডের পর আবারও প্রবলভাবে একটি কথা ভেতর থেকে উচ্চারিত হচ্ছে-এই ভাবে আর চলতে পারে না, চলতে দেওয়া উচিত নয়।

সাম্প্রতিক দশকে অসংখ্য দুর্ঘটনার বেদনা সঞ্চয় করেছি। গাজীপুর চৌরাস্তায় গরিব অ্যান্ড গরিব কারখানা, সাভারের নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন গার্মেন্টস, পুরান ঢাকার নিমতলী, চুরিহাট্টা, চট্টগ্রামের কন্টেনেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ডে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেওয়া যাবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে সারাদেশে দেড় লাখ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একহাজার ৪৯০ জনের মৃত্যু এবং ৬ হাজার ৯৪১ জন দগ্ধ হয়েছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ২২ হাজার ২৮৩টি অগ্নিকাণ্ডে ২ হাজার ১৩৮ জনের মৃত্যুর তথ্য জানা যাচ্ছে। গেল ৫ বছরের সংখ্যাও বিপুল।

এই অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স, সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো বছরজুড়ে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা আমরা জানি না। কিন্তু কোন দুর্ঘটনা সংঘটিত হলেই প্রত্যেককে আমরা সরব হতে দেখি। তারা পরস্পর পরস্পরকে দায় চাপাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বছরজুড়ে তদারকি ও আইন অমান্যে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার তৎপরতা আমরা দেখি না। উল্টো কত রকমের ফন্দিফিকির করে ঘুষ দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নিতে হয়, সেই খবরই বেশি মাত্রায় আমাদের চোখে পড়ে।

মানুষের প্রাণের মূল্য কতটা কম সংশ্লিষ্টদের কাছে, যে অগ্নি সুরক্ষার মতো গুরুতর বিষয়েও কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করা যায়! এটি যে কিছু সংখ্যক মানুষ, কিছু সময় ধরে এটি করে আসছেন তাই নয়। গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, নিয়ম-নীতির এই শৈথিল্য দেখানোর চক্রে বড় সিন্ডিকেট রয়েছে। যাঁরা আইনকানুন মেনে চলতে চান, তাদের জন্যও এই সিন্ডিকেট বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এবং সকলেই একপর্যায়ে অনিয়মকেই নিয়ম হিসেবে তা মেনে নেন। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে মাঝেমধ্যে কিছু মহড়ার আইওয়াশ আমরা দেখি যা নিতান্তই লোক দেখানো। বিপুল সংখ্যক ভবন অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির মধ্যে রেখে এই আইওয়াশে আমরা যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই রয়ে যাই। তাই সংশ্লিষ্টদের ‘জেগে ঘুমিয়ে থাকা’র এই প্রবণতা যদি সমূলে উৎপাটন করা না যায় তবে আমরা আগামীতে আরও বড় অগ্নিকাণ্ড হয়ত দেখব। গণমাধ্যমকর্মী আর উদ্ধারকারীরা নিহতের সংখ্যা মেলাতেই ব্যস্ত থাকবেন।

 


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর