news2bdgazette@gmail.com শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

বুয়েটে ‘রাজনীতি বন্ধের’ বিক্ষোভও একটি রাজনৈতিক আন্দোলন

এস এম রাকিব সিরাজী

প্রকাশিত:
১ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:২৪

ছবি: সংগৃহীত

বুয়েটের ছাত্র রাজনীতি নিয়ে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই দেশের সেরা এই বিদ্যাপীঠটিতে ‘রাজনীতি’ বন্ধ রাখার পক্ষে যেসব কথাবার্তা বা যুক্তি সোশাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে তা পড়ছিলাম। যেখানে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির সুযোগ না দেওয়ার স্বপক্ষে উদ্ভট নানা যুক্তিতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। সেখানে যা বলা হচ্ছে তার নমুনা অনেকটা এরকম, ‘ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা তো বটেই এশিয়ার দেশ জাপান, সিঙ্গাপুর,মালয়শিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার মত দেশসমূহের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নাকি কোনো ছাত্র রাজনীতি নেই! ঐ দেশগুলো দ্রুততম সময়ে অনেক উন্নতি লাভ করেছে এবং উল্লেখিত দেশসমূহের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়াশোনার পরিবেশ, গবেষণার মান অনেক ভালো । ঐসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে গ্রাজুয়েশন করা শিক্ষার্থীরা দেশ গঠনে আমাদের তুলনায় অনেক ভালো এবং অনেক বেশি ভূমিকা রাখছেন।’

আরও যুক্তি দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নেতা-কর্মীরা পড়াশোনা কিংবা দক্ষতা অর্জন (স্কিল ডেভেলপমেন্ট) কিংবা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার নীতি নির্ধারণ (পলিসি ম্যাকিং) সম্পর্কে ঠিক ততটাই অজ্ঞ, রাজনীতির সাথে সম্পর্কহীন ব্যক্তিটি যতটা অভিজ্ঞ’ ইত্যাদি। এসব যুক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তি দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্য নয় বরং আমরা মনে করি যেকোনো বিষয় নিয়ে উন্মুক্ত বিতর্ক ও পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা আমাদেরকে সুন্দর একটি সমাধান দিতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতি না থাকার যে উদাহরণ দেয়া হচ্ছে প্রকৃতঅর্থে একটি ভুল উদাহরণ। ছাত্র রাজনীতি বলতে যারা বাংলাদেশ বা উপমহাদেশীয় ধাঁচের রাজনীতিকে বোঝেন, মূলত তারাই বলছেন অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, এমআইটি কোথাও ছাত্ররাজনীতি নেই।

বাস্তব সত্য হচ্ছে, প্রচারণায় দাবি করা তথ্যগুলো সর্বাংশেই ভুল। এটি জানা খুব দুরূহ নয় যে, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, এমআইটি কিংবা ক্যামব্রিজসহ পৃথিবীর নামকরা সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই ‘স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বা স্টুডেন্ট ক্যাবিনেট’নামে ছাত্রসংসদ রয়েছে; ঠিক যেমন আমাদের দেশেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছাত্রসংসদ রয়েছে। ওইসব ছাত্রসংসদে নিয়মিত ভোট হয়, দায়িত্বের পালাবদলের জন্য প্রতি বছর নির্বাচন হয়। আর নির্বাচন মানেই তো গণতান্ত্রিক রাজনীতির উৎকৃষ্ট উপকরণটির চর্চার সাথে নিজেদেরকে ছাত্রজীবন থেকেই অভ্যস্ত করা।

শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে ছাত্রসংসদের নির্বাচিত নেতৃত্ব ছাত্রছাত্রীদের জন্য কাজ করেন। শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া, সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা বলেন-এটিই কিন্তু ছাত্ররাজনীতি। বলাবাহুল্য, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি থাকবে নাকি থাকবে না, এই ইস্যুতে যে আন্দোলন চলমান, এটিও একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। আবরার হত্যার বিচার চেয়ে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করেছিলো, সেটিও রাজনৈতিক আন্দোলন। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা অথবা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিচার ব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ রাখা, এটিও সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধামূলক একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ । সুতরাং পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে কিংবা উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি নেই, এটি একটি ভুল ধারণা বা অপপ্রচার।

তবে এটি সত্য যে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে আমাদের দেশ কিংবা উপমহাদেশের ছাত্ররাজনীতির ফারাক বিস্তর। এই ফারাক কেন এবং কীভাবে কমানো উচিত বা আদৌও কমানো উচিত কিনা সেটি ভিন্ন বিতর্ক। চলমান ইস্যুতে ছাত্ররাজনীতি না থাকার পক্ষে দ্বিতীয় যে যুক্তিটির কথা আমরা শুনছি , তার সঙ্গে আমি বা আমরা সবাই কমবেশি একমত যে আমাদের ছাত্ররাজনীতির কর্মীরা পড়াশোনা কম করতে চান, দক্ষতা অর্জনে ( স্কিল ডেভেলপমেন্ট) কম মনোযোগী, সৃজনশীল চিন্তা (ক্রিয়েটিভ থিংকিং) কম করতে চান, যুক্তির জোরের চেয়ে জোরের যুক্তি বেশি প্রতিষ্ঠা করতে চান। বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক সংগঠন এই বিষয়ে মোটামুটি একমত পোষণ করবেন। এ থেকে উত্তরয়নের জন্য কি করা উচিত, সেটিও অন্য একটি বিতর্ক।

তাই ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দেওয়ার চলমান বিতর্কের প্রধান যুক্তিগুলোর সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে ‘মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা’র আন্দোলন । আপনারা মাথাব্যথার চিকিৎসার কথা না বলে সরাসরি মাথা কেটে ফেলতে চাচ্ছেন! তো, মাথা কেটে ফেললে এর ফলাফল কি হবে ? মনে করুন, আপনাদের কথা কিংবা দাবিকে যৌক্তিক ধরে নিয়ে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দিতে একমত হলো । কোথাও কোনো ছাত্ররাজনীতি নেই। আপনার ক্যাম্পাসে ফুটবল খেলা নিয়ে দুই পক্ষের ঝামেলা হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মিটমাট করে দিবে, আপনার ক্যাম্পাসে কোনো ফৌজদারি অপরাধ হলে প্রচলিত আইনে বিচার হবে, আপনার ক্যাম্পাসে বড় ধরনের কোনো সংঘাত-বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন হবে। ভালো কথা। কিন্তু যদি সর্ষের ভিতরেই ভূত থাকে? যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউ দুর্নীতি করে? যদি কোনো শিক্ষক তাঁর ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন করে? যদি কোনো শিক্ষক তার ছাত্রকে নম্বর দিতে বৈষম্য করে? যদি ছাত্রছাত্রীদের খাবারের মান নির্ধারণে তালবাহানা চলে? পরিবহণ ব্যবস্থার সংকট থাকে? আবাসন সংকট থাকে? যদি কোনো গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে একটি দেশের মৌলিক আদর্শের বিরুদ্ধে তাদের নিজস্ব উগ্র আদর্শ প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে গোপনে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কাজ করে? যদি হলি আর্টিজেনের হামলায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের আদর্শের ন্যয় আদর্শ বিস্তারের জন্য গোপনে কার্যক্রম চলমান থাকে?

এর সমাধান কীভাবে করবেন? কেউ কেউ এই যুক্তি দেন যে, এসব দেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রয়েছে , আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে, দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা রয়েছে । আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারাী বাহিনীকে কি আপনার হলের চাল-ডালের মান নির্ধারণের জন্য তৈরী করা হয়েছে বলে মনে হয় ? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কি কোনো গোয়েন্দা সংস্থা যে তারা গোপনে অনুসন্ধান করবে কারা উগ্রবাদী কার্যক্রম চালায় আর কারা চালায় না? শক্তিশালী দাবি না উঠলে আপনার ক্যাম্পাসে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া মেয়েটির ন্যয় বিচার নিশ্চিত করার জন্য কি রোবট দিয়ে আন্দোলন করাবেন?

সুতরাং ‘ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন নেই’ বলে যারা চিৎকার করছেন, সেটিও একটি রাজনৈতিক আওয়াজ । ছাত্র রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে নিষিদ্ধ রাজনীতিকে বেগবান করার একটি রাজনৈতিক পায়তারা ছাড়া এটি আর কিছুই নয়। পৃথিবীর কোথাও ছাত্ররাজনীতি নেই বলে যে বয়ান দেয়া হচ্ছে এটি মূলত গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে রাজনীতি সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা না থাকা মানুষদের বয়ান । হ্যা, এখন, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এসে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ধরণ কেমন হওয়া উচিত বা একুশ শতকের বাস্তবতা কিংবা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ছাত্র রাজনীতির কার্যক্রম কেমন হওয়া উচিত, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী নাগরিক তৈরী করতে হলে ছাত্র রাজনীতি কেমন হওয়া উচিত, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এই লেখার বিষয় সেটি নয়। এই লেখাটি মূলত ছাত্ররাজনীতি না রাখার পক্ষে প্রজন্মের একটি অংশের নানান কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে।

এরিস্টটল বলেছিলেন, ‘'মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক জীব’। সত্যিই তাই- রান্নাঘর থেকে জাতিসংঘ পর্যন্ত আমাদের যত কাজ, কথা-বার্তা, বিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনা, যুক্তি, চুক্তি, জোট, ভোটের আয়োজন হয়, সবই রাজনৈতিক বিষয়। তাছাড়া রাজনীতি করার অধিকার মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। কে রাজনীতি করবে আর কে রাজনীতি করবে না সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় । স্বায়ত্তশাসন কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে একজন মানুষের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করা ফৌজদারি অপরাধের শামিল । আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে পৃথিবীর কোন্ দেশে কি আছে আর কোন্ দেশে কি নেই, তা দেখে আমার দেশে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছু নেই।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশকে অনুসরণ করে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র নাকি রাজতন্ত্র চলবে, নাকি একনায়কতন্ত্র চলবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াই কঠিন হয়ে যাবে। কারণ, পৃথিবীর সব দেশ গণতান্ত্রিক নয়। পৃথিবীর অন্য দেশ কি পোশাক পরে তা দেখে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে গেলেও ঝামেলা বাঁধবে। কারণ ইউরোপের মানুষ যে ধরনের পোশাক পরে, তুরস্ক বা সৌদি আরবের মানুষজন তার ঠিক বিপরীত রকম পোশাক পরে। সুতরাং অনুসরণ-অনুকরণ সবসময় ভালো জিনিস নয়। আমার দেশের নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে, ঐতিহ্য রয়েছে, সংস্কৃতি রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমাদের দেশের মানুষের স্বতন্ত্র রুচিবোধ, ব্যতিক্রমী মেজাজ, স্বতন্ত্র সামাজিক ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং একটি দেশের সবকিছু তাদের নিজেদের মত করেই হওয়া উচিত।

যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি না থাকার মত হয়, না থাকুক। যদি তরুণ প্রজন্ম রাজনীতির চেয়ে ক্যারিয়ারকে বেশি প্রাধান্য দিতে চায়, দিক। যদি রাজনৈতিক কর্মীরা পড়াশোনায় পিছিয়ে থেকে, দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে থেকে সমাজে পিছিয়ে পড়ে, পড়ুক। যদি রাজনীতি না করা মানুষেরা পড়াশোনায় এগিয়ে থেকে, দক্ষতায় এগিয়ে থেকে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যায়, যাক্। সেক্ষেত্রে একদিন হয়তো রাজনীতির সংস্কার হবে অথবা সবাই রাজনীতি ছেড়ে দিবে, সেটাও দিক্। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য যা পরিবর্তন দরকার তা স্বাভাবিকভাবেই হোক। আমরা চাই, যাই হোক, যাই ঘটুক তা প্রাকৃতিকভাবে ঘটুক। কিন্তু রাজনীতি বন্ধ করার দাবিতে সংঘবদ্ধ বিক্ষোভ, আরেকটি ‘রাজনৈতিক আন্দোলন’ ছাড়া আর কিছুই নয়।

লেখক: কারিগরি ও শিক্ষা সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ ও সাবেক সভাপতি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি

 


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর